শূন্যস্থানে X-অক্ষ বরাবর আলো সঞ্চালনের সময় তড়িৎক্ষেত্রের জন্য যে তরঙ্গ সমীকরণ লেখা যেতে পারে তা হলো
… (7.1)
এখানে E হলো t সময়ে x অবস্থানে সাইনসদৃশভাবে পরিবর্তনশীল তড়িৎক্ষেত্র, c শূন্যস্থানে আলোর দ্রুতি এবং হলো তরঙ্গদৈর্ঘ্য । তড়িৎক্ষেত্র E রয়েছে Y Z তলে [চিত্র ৭.১]। সুতরাং আলো সঞ্চালন অভিমুখের সাথে লম্ব এবং Eo হলো তড়িৎক্ষেত্রের বিস্তার বা শীর্ষ মান। আলো সঞ্চালনের সময় তড়িৎক্ষেত্রের সাথে থাকে সাইনসদৃশভাবে পরিবর্তনশীল চৌম্বকক্ষেত্র B। চৌম্বকক্ষেত্র এর সঞ্চালনের অভিমুখ তড়িৎক্ষেত্র এর অভিমুখের সাথে লম্ব। চৌম্বকক্ষেত্র B এর জন্য তরঙ্গ সমীকরণটি হলো :
….(7.2)
এখানে Bo হলো চৌম্বকক্ষেত্রের বিস্তার বা শীর্ষ মান ।
তড়িৎ ও চৌম্বকক্ষেত্রের এরকম পরস্পর লম্ব সমবায়কে বলা হয় শূন্যস্থানে তাড়িতচৌম্বকীয় তরঙ্গ। তাড়িতচৌম্বকীয় তরঙ্গ তড়িৎ আধানের ত্বরণ থেকে উৎপন্ন হয়। বিকীর্ণ তরঙ্গ গঠিত হয় তড়িৎ ও চৌম্বকক্ষেত্রের পর্যায়ক্রমিক হ্রাস বৃদ্ধির মাধ্যমে। তড়িৎ ও চৌম্বকক্ষেত্র সর্বদাই পরস্পর সমকোণে থাকে। এছাড়া এগুলো সঞ্চালনের অভিমুখের সাথেও সমকোণে থাকে। সুতরাং ভাড়িতচৌম্বকীয় তরঙ্গ হলো আড় বা অনুগ্রস্থ তরঙ্গ।
ম্যাক্সওয়েলের তত্ত্ব থেকে জানা যায় যে, তাড়িতচৌম্বকীয় তরঙ্গে তড়িৎ ও চৌম্বকক্ষেত্রের বিস্তার যথাক্রমে Eo ও Bo নিচের সম্পর্ক দ্বারা সম্পর্কিত।
বা,
যেখানে c আলোর দ্রুতি । এ সমীকরণকে c = হিসেবেও লেখা যায়। B এ ছাড়া ম্যাক্সওয়েল শূন্যস্থানে তাড়িতচৌম্বকীয় তরঙ্গের বেগকে নিচের সমীকরণ দ্বারা প্রকাশ করেন।
এখানে হচ্ছে শূন্যস্থানের চৌম্বক প্রবেশ্যতা (permeability) এবং হচ্ছে শূন্যস্থানের তড়িৎ ভেদনযোগ্যতা (permitivity) ।
আমরা জানি যে, পরিবর্তনশীল চৌম্বক ফ্লাক্স তড়িৎক্ষেত্র উৎপন্ন করে এবং পরিবর্তনশীল তড়িৎ ফ্লাক্স চৌম্বকক্ষেত্র সৃষ্টি করে। এ থেকে বোঝা যায় যে, কোনো অঞ্চলে যদি তড়িৎ বা চৌম্বক ফ্লাক্সের পরিবর্তন ঘটে, তাহলে সে অঞ্চলের বাইরে পারিপার্শ্বিক স্থানে আলোর দ্রুতিতে তাড়িতচৌম্বকীয় ক্ষেত্র সঞ্চালিত হবে। এরকম চলাচলকারী তড়িৎ ও চৌম্বক ক্ষেত্রকে বলা হয় তাড়িতচৌম্বকীয় বিকিরণ বা তাড়িতচৌম্বকীয় তরঙ্গ। সুতরাং তাড়িতচৌম্বকীয় তরঙ্গ হলো কোনো স্থান দিয়ে আলোর দ্রুতিতে গতিশীল তড়িৎ ও চৌম্বক আলোড়ন। এ তরঙ্গে তড়িৎ ও চৌম্বকক্ষেত্র সর্বদা সমকোণে থাকে। উভয়ক্ষেত্র সঞ্চারণের অভিমুখের সাথে সমকোণে থাকে। এ তরঙ্গ তাই আড় তরঙ্গ। কয়েকটি তাড়িতচৌম্বকীয় তরঙ্গের নাম হলো বেতার তরঙ্গ (radio wave), মাইক্রো তরঙ্গ (microwave), অবলোহিত তরঙ্গ (infrared wave), দৃশ্যমান আলো (visible light), অতি বেগুনি বিকিরণ (ultraviolet radiation), এক্সরে (x-ray) ও গামারশ্মি (gamma ray)।
এর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের পাল্লা 7.80 x 10-7m থেকে 3.80 x 10-7m। এটি বিকিরণের একটি ক্ষুদ্র পটি বা ব্যান্ড (band) যার মধ্যে রয়েছে লাল থেকে বেগুনি আলো। দৃশ্যমান আলো কোনো অগ্নিশিখা বা ভাস্বর বস্তু থেকে উৎপন্ন হয় এবং মানব চক্ষু, ফটোগ্রাফিক ফিল্ম ও ফটোইলেকট্রিক সেল দ্বারা উদ্ঘাটিত হয়।
এই বিকিরণ 10-6m থেকে 10-8m তরঙ্গদৈর্ঘ্যের পাল্লায় একটি বিকিরণ ব্যান্ড। এ ধরনের বিকিরণ উত্তপ্ত বস্তু যেমন সূর্য, তড়িৎশিখা ও তড়িৎচুল্লি থেকে উৎপন্ন হয়। এ বিকিরণকে থার্মোপাইন (thermopine), ফটোট্রানজিস্টর ইত্যাদি দ্বারা উদ্ঘাটন করা যায়। এই বিকিরণ প্রতিফলন ও প্রতিসরণের সূত্র মেনে চলে। এর ব্যতিচার ও সমবর্তন (polarization) ঘটে। কোনো বস্তুতে পতিত হলে বস্তুর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। এর বেগ আলোর বেগের সমান। এ বিকিরণ সৌরচুল্লি ও সৌর হিটারে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া আবহাওয়ার পূর্বাভাস দিতে, কুয়াশার মধ্যে ছবি তুলতে, ফলকে শুষ্ক করতে, মাংসপেশির ব্যথা বা টান এর চিকিৎসায় এ রশ্মি ব্যবহৃত হয়।
তাড়িতচৌম্বকীয় বিকিরণের মধ্যে যাদের তরঙ্গদৈর্ঘ্যের পাল্লা 10 -2m থেকে 5 x 104 m তাদের বলা হয় বেতার তরঙ্গ। বেতার তরঙ্গকে আবার কয়েকটি উপবিভাগে ভাগ করা যায়। এরা হলো মাইক্রোওয়েভ বা মাইক্রোতরঙ্গ; রাডার তরঙ্গ ও টেলিভিশন তরঙ্গ।
বেতার তরঙ্গ উৎপাদিত হয় তড়িৎ স্পন্দনের মাধ্যমে। সাধারণ কোনো অ্যারিয়েল বা অ্যানটেনা দ্বারা ইলেকট্রনকে স্পন্দিত করে বেতার তরঙ্গ উৎপাদন করা হয়। দূরবর্তী স্থানে শব্দ বা ছবি প্রেরণের জন্য এ বেতার তরঙ্গ ব্যবহার করা হয়।
এ তরঙ্গের শক্তি তড়িৎ ও চৌম্বক এ দুই ক্ষেত্রের মধ্যে সমানভাবে বণ্টিত থাকে। মধ্যম ও দীর্ঘ তরঙ্গের পথে বাধা থাকলেও অপবর্তনের মাধ্যমে তাদের পথের বাধা (পাহাড়-পর্বত) পেরিয়ে যেতে পারে। ফলে ট্রানজিস্টর ও রেডিও সিগন্যাল প্রেরক অ্যানটেনা থেকে গ্রাহক যন্ত্রে পৌঁছায়। এছাড়া পৃথিবীর ঊর্ধ্ব বায়ুমণ্ডলের আধানযুক্ত কণিকার স্তর দ্বারা মধ্যম ও দীর্ঘ বেতার তরঙ্গ প্রতিফলিত হয়। ভূ-পৃষ্ঠের বাঁক থাকা সত্ত্বেও দূরবর্তী স্থানে এ ধরনের তরঙ্গ সঞ্চালিত হতে পারে। টেলিভিশন (VHF ও UHF) তরঙ্গের তরঙ্গদৈর্ঘ্য ক্ষুদ্রতর। এরা ঊর্ধ্ব বায়ুমণ্ডলের স্তর থেকে প্রতিফলিত হয় না। এবং কোনো উঁচু বাধা (যেমন পাহাড়-পর্বত) দ্বারা খুব সামান্যই পরিবর্তিত হয়। গ্রাহকযন্ত্রে উত্তম সিগন্যাল পেতে হলে এই ধরনের তরঙ্গের জন্য প্রেরক অ্যানটেনা থেকে গ্রাহক (টিভি) অ্যারিয়েল পর্যন্ত ভ্রমণ-পথ সরলরেখা হওয়া উচিত
এ জন্য দূরবর্তী স্থানে টেলিভিশন তরঙ্গ কৃত্রিম উপগ্রহ বা (স্যাটেলাইট)-এর মাধ্যমে রিলে (relay) করা হয় ।
নাম থেকেই বোঝা যায় যে, তাড়িতচৌম্বকীয় বর্ণালির দৃশ্যমান আলোর বেগুনি প্রান্ত ছাড়িয়ে এ বিকিরণের অবস্থান। এর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের পাল্লা 5 x 10-7m থেকে 5 x 10-9m। কার্বন-আর্ক-ল্যাম্প, উত্তরে বস্তু ও সূর্য থেকে এই বিকিরণের উৎপত্তি হয়। এই বিকিরণকে ফটোগ্রাফিক প্লেট ও প্রতিপ্রভা দ্বারা উদ্ঘাটন করা যায়। এই বিকিরণ প্রতিফলন ও প্রতিসরণের সূত্র মেনে চলে। এর ব্যতিচার ও সমবর্তন ঘটে। কোনো বস্তুতে পতিত হলে তা থেকে ফটোইলেক্ট্রন নির্গত হয়। কোনো পদার্থে প্রতিপ্রভার সৃষ্টি করে ।
চুরি নিরোধক অ্যালার্ম, স্বয়ংক্রিয়ভাবে দরজা খোলার যন্ত্র ও কাউন্টারে এ বিকিরণ ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়া আসল হীরা ও নকল ব্যাংক নোট উদ্ঘাটনে অতি বেগুনি বিকিরণ ব্যবহৃত হয়। শল্য চিকিৎসায় যন্ত্রপাতি জীবাণুমুক্ত করতে এ বিকিরণ ব্যবহৃত হয় ।
এক্স-রে তরঙ্গদৈর্ঘ্যের পাল্লা 5x10-8 m থেকে 5 x 10-15 m-এর মধ্যে। সুতরাং এর এক প্রাপ্ত অতি বেগুনি বিকিরণ ও অপর প্রাপ্ত গামা রশ্মির পাল্লার ওপর উপরিলেপিত হয়। অত্যন্ত দ্রুতগতিসম্পন্ন ইলেকট্রনকে কোনো ভারী ধাতব বস্তু দ্বারা থামিয়ে দিলে এক্স-রে উৎপন্ন হয়। একে ফটোগ্রাফিক প্লেট বা ফিল্ম দ্বারা উদ্ঘাটন করা যায় । এছাড়া ধাতুতে তাড়িতচৌম্বকীয় প্রভাব তৈরি করে এবং গ্যাসে আয়নায়ন সৃষ্টি করে এক্স-রে উদ্ঘাটন করা যায়। ভাঙা হাড় ও দেহের অভ্যন্তরস্থ কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ছবি তুলতে এক্স-রে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া দেহের ক্ষতিকারক সেল টিউমার ধ্বংস করতে ব্যবহৃত হয়। কোনো ধাতব যন্ত্রের কোথাও কোনো ফাটল আছে কিনা তা শনাক্ত করতেও এক্স-রে ব্যবহৃত হয়।
এর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের পাল্লা 5 x 10-11 m থেকে 5 x 10-15 m বা এর চেয়েও কম। তরঙ্গদৈর্ঘ্যের দিক দিয়ে এটি এক্স-রের অঞ্চলে উপরিলেপিত হয়। তেজস্ক্রিয় নিউক্লিয়াস থেকে এ রশ্মি নির্গত হয়। ফটোগ্রাফিক প্লেট ও গাইগার মূলার কাউন্টার দিয়ে এ রশ্মি উদ্ঘাটন করা যায়। মানবদেহে ক্যান্সার আক্রান্ত কোষকে ধ্বংস করতে এই রশ্মি ব্যবহৃত হয়।
সূর্যের সাদা আলোর বর্ণালিতে রয়েছে বেগুনি, নীল, আসমানী, সবুজ, হলুদ, কমলা ও লাল রঙের সাতটি আলো। রংগুলোর নাম ও ক্রম সহজে মনে রাখার জন্য এদের নামের আদ্যাক্ষরগুলো নিয়ে ইংরেজিতে VIBGYOR ও বাংলা বেনীআসহকলা শব্দ গঠন করা হয়। এই রংগুলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের পাল্লা নিচে দেয়া হলো :
বেগুনি : 3.80 x 10-7m থেকে 4.25 x 10-7m
নীল : 4.25 x 10-7m থেকে 4.45 x 10-7m
আসমানী : 5.00 x 10-7m থেকে 5.75 x 10-7m
সবুজ : 5.75 x 10-7m থেকে 5.85 x 10-7m
হলুদ : 5.85 x 10-7m থেকে 6.20 x 10-7m
কমলা : 6.20 x 10-7m থেকে 7.80 x 10-7m
লাল : 4.45 x 10-7m থেকে 5.00 x 10-7m
কোনো তরঙ্গের বেগ v হলে t সময়ে তরঙ্গ vt দূরত্ব অতিক্রম করে। কোনো বিন্দু উৎসকে কেন্দ্র করে vt ব্যাসার্ধের একটি গোলক কল্পনা করলে এই গোলক পৃষ্ঠ t সময়ের তরঙ্গমুখ নির্দেশ করে। এ t সময়ে গোলকের পৃষ্ঠের প্রতিটি কম্পমান কণা একই দশায় থাকে। সুতরাং যে কোনো সময় তরঙ্গমুখ সেই তল নির্দেশ করে যে তলে কণাসমূহ একই দশায় কম্পমান থাকে। সময়ের সাথে সাথে তরঙ্গমুখসমূহ সমান্তরালভাবে অগ্রসর হয় (চিত্র ৭.৩-এ A, B, C, D, E )।
তরঙ্গমুখের সাথে সমকোণে অঙ্কিত সরলরেখা ঐ তরঙ্গ যে শক্তি সঞ্চারণ করে সেই শক্তি সঞ্চারণের দিক নির্দেশ করে। ৭.৩ চিত্রে আলোক উৎস O থেকে A, B, C বা D তরঙ্গমুখের সমকোণে অঙ্কিত OP, OQ, OR প্রভৃতি রেখা বিভিন্ন দিকে আলোক সঞ্চারণের দিক নির্দেশ করে। এদের আলোক রশ্মি বলে। আলোক রশ্মি তরঙ্গমুখের সাথে সমকোণে থাকে। তরঙ্গমুখ যে সর্বদা গোলীয় হবে এমন কোনো কথা নেই। কোনো বিন্দু উৎস থেকে সমসত্ত্ব মাধ্যমে অল্প দূরত্বে তরঙ্গমুখ গোলীয় হবে। বহু দূরবর্তী কোনো উৎস থেকে আগত তরঙ্গমুখের বক্রতা এত সামান্য যে এর অংশবিশেষকে সমতল ধরা যায়। যে কারণে সূর্যের আলোর তরঙ্গমুখকে সমতল বিবেচনা করা যায় ।
সুতরাং একগুচ্ছ অভিসারী বা অপসারী আলোক রশ্মির তরঙ্গমুখ গোলীয় এবং সমান্তরাল আলোক রশ্মির তরঙ্গমুখ সমতল হবে।